সর্বশেষ প্রকাশিত

পে-কমিশনের প্রতি কর্মচারীদের জরুরি দাবি: সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার চাই

সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নতুন পে-কমিশনের কাছে নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি পেশ করেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা বিশেষ করে সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের দাবির মধ্যে অন্যতম হলো, গ্রেড সংখ্যা কমানো এবং বেতন কাঠামোতে বৈষম্য দূর করা।

মূল দাবি ও প্রস্তাবনা

  • গ্রেড সংখ্যা হ্রাস: বর্তমানে প্রচলিত ২০টি গ্রেড কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২টি গ্রেড নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ১৭-২০ গ্রেডকে চতুর্থ শ্রেণি, ১৪-১৬ গ্রেডকে তৃতীয় শ্রেণি, ১০-১৩ গ্রেডকে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ৯ম ও তদূর্ধ্ব গ্রেডকে প্রথম শ্রেণি হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে গ্রেডগুলোর মধ্যে কোনো মিশ্রণ থাকবে না।
  • ন্যূনতম বেতন ও অনুপাত: সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ১:৪ নির্ধারণ করে ন্যূনতম বেতন ৩৫,০০০ টাকা করার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি, প্রতিটি গ্রেডে বেতনের ব্যবধান সমান পরিমাণে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
  • ভাতা বৃদ্ধি ও যুক্তিসঙ্গতকরণ:
    • বাড়িভাড়া ভাতা: একটি ৬ সদস্যের পরিবারের জন্য ন্যূনতম ৩টি বেডরুমের ফ্ল্যাটের কথা বিবেচনা করে বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার জন্য ৭৫%, বিভাগীয় শহরের জন্য ৭০% এবং জেলা পর্যায়ের জন্য ৬৫% বাড়িভাড়া নির্ধারণের দাবি জানানো হয়েছে।
    • চিকিৎসা ভাতা: চিকিৎসা ভাতা ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা করার দাবি করা হয়েছে।
    • লাঞ্চভাতা: টিফিন ভাতার পরিবর্তে প্রতিদিন ২৫০ টাকা করে লাঞ্চভাতা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
    • অন্যান্য ভাতা: এক সন্তানের জন্য ৩,০০০ টাকা এবং দুই সন্তানের জন্য ৬,০০০ টাকা শিক্ষা সহায়ক ভাতা, মূল বেতনের ৫০% বৈশাখী ভাতা, মাসিক ৩,০০০ টাকা যাতায়াত ভাতা, রোজা মাসে ৫,০০০ টাকা ইফতারি ভাতা এবং মাসিক ১,০০০ টাকা মোবাইল ও ইন্টারনেট বিলের জন্য ভাতার দাবি করা হয়েছে।
  • অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবি:
    • সকল সরকারি কর্মচারীর জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো রেশন ব্যবস্থা চালু করা।
    • স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরকেও পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনা।
    • সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ফ্ল্যাট বা বাড়ি নির্মাণের জন্য ৫০ লাখ থেকে ৯০ লাখ টাকা পর্যন্ত এবং গাড়ি কেনার জন্য যৌক্তিক পরিমাণে ঋণ ব্যবস্থা চালু করা।
    • ‘ব্লকপোস্ট’ বাতিল করে পুনরায় সার্ভিস বেনিফিট, টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল করা।

পে-কমিশনের প্রতি আহ্বান:

কর্মচারীরা পে-কমিশনের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্যদের প্রতি বিনীতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন, তারা যেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সৃষ্ট কষ্ট বিবেচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। তারা দাবি করেছেন, ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে পে-স্কেলের প্রজ্ঞাপন জারি করে জুলাই ২০২৫ থেকে এটি কার্যকর এবং জানুয়ারি ২০২৬ থেকে বাস্তবায়ন করা হোক। কর্মচারীরা বলছেন, তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য এই বেতন কাঠামো খুবই জরুরি।

নতুন পে স্কেল কতটা জরুরি?

নতুন পে স্কেল ঘোষণা করা সরকারি কর্মচারীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ২০১৫ সালে সর্বশেষ পে স্কেল ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, যার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে গড় মুদ্রাস্ফীতি ৯.৪৮% এবং ২০২৪ সালে ১০.৩৪% ছিল। খাদ্যপণ্যের দাম অনেক ক্ষেত্রে ১৪.১০% পর্যন্ত বেড়েছিল। এর ফলে সরকারি কর্মচারীদের, বিশেষ করে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের, প্রকৃত আয় কমে গেছে এবং তাদের পক্ষে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমান বেতন কাঠামোতে বিভিন্ন গ্রেডের মধ্যে কিছু বৈষম্য রয়েছে। নতুন পে স্কেলের মাধ্যমে এই বৈষম্যগুলো দূর করা সম্ভব। কর্মচারীদের দাবি অনুযায়ী, গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ কর্মচারীদের বেতনের মধ্যকার পার্থক্য যৌক্তিক করার মাধ্যমে বেতন কাঠামোতে সমতা আনা যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে নতুন পে স্কেল না হওয়ায় কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। নতুন পে স্কেল ঘোষণা হলে তা তাদের অর্থনৈতিক চাপ কমাবে এবং মানসিক স্বস্তি দেবে। বেতন বৃদ্ধি পেলে কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যখন একজন কর্মচারী তার বেতন ও জীবনযাত্রার মান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন, তখন তার কাজের প্রতি মনোযোগ ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। বর্ধিত বেতন ও ভাতা কর্মচারীদেরকে তাদের কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি উৎসাহিত করবে এবং সরকারি সেবার মান উন্নত করতে সহায়ক হবে। নতুন পে স্কেলের মাধ্যমে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত, মোবাইল এবং ইন্টারনেট বিলের মতো ভাতাগুলো বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ করা যাবে। যেমন, ৬ সদস্যের একটি পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বাস্তবসম্মত বাড়িভাড়া ভাতা নির্ধারণ করা জরুরি। অন্যান্য ভাতাও একইভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা প্রয়োজন।

সাধারণত প্রতি ৫ বছর পরপর নতুন পে স্কেল ঘোষণার একটি নিয়ম থাকলেও, ২০১৫ সালের পর দীর্ঘ ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন পে স্কেল আসেনি। ফলে কর্মচারীদের মধ্যে এক দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, যা পূরণ করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সংক্ষেপে, নতুন পে স্কেল শুধুমাত্র বেতন বৃদ্ধির একটি বিষয় নয়, বরং সরকারি কর্মচারীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে উৎসাহ বৃদ্ধি, এবং সর্বোপরি, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *