সর্বশেষ প্রকাশিত

“সরকারি চাকরি, কিন্তু পকেট ফাঁকা”: মূল্যবৃদ্ধির যাঁতাকলে ‘সুবিধাভোগী’ তকমা নিয়ে বেঁচে থাকা

এক হতভাগা সরকারি কর্মচারীর অপ্রকাশিত আর্তনাদ- বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছে, কিন্তু স্থির হয়ে আছে একটি শ্রেণির আয়—তারা হলেন সরকারি কর্মচারী। একদিকে আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে সমাজের ভুল ধারণা ও কটাক্ষ—এই দুইয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন অসংখ্য সরকারি চাকরিজীবী। তাঁদের মুখে শোনা যায় এক চাপা আর্তনাদ, যা লোকলজ্জা ও সামাজিক চাপের কারণে কখনও প্রকাশ্যে আসে না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাল, ডাল থেকে শুরু করে শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক খাতেও ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। অথচ, দীর্ঘকাল ধরে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামোতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে, সীমিত আয়ের এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রার মান ক্রমশ নিম্নমুখী।

“টাকা থেকেও না থাকার ভান করি!”

একজন সরকারি কর্মচারী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) আক্ষেপ করে বলেন, “বাজার করতে গেলেই হাত কাঁপে। ছেলে-মেয়েরা সামান্য একটা আবদার করলে ‘নেই’ বলতে কষ্ট হয়। ধার চাইলে বা মাসের শেষে একটু বাকী করতে গেলেই দোকানিরা বলে, ‘আপনার আবার অভাব! সরকারি চাকরি করেন, মজা করছেন নাকি?’ আত্মীয়-স্বজনের কাছেও যদি সংসারের কষ্টের কথা বলি, তারা হাসে। তাদের ধারণা, সরকারি চাকরি মানেই অফুরন্ত টাকা, অথচ বাস্তবতা হলো, প্রতি মাসের মাঝামাঝি সময়েই আমাদের পকেট ফাঁকা হয়ে যায়।”

সমাজের এই ‘সুবিধাভোগী’ তকমাটিই যেন তাঁদের সবচেয়ে বড় বোঝা। বাইরে থেকে দেখলে সরকারি চাকরি মানেই নিশ্চিন্ত জীবন, ভালো মাইনে আর বাড়তি সুযোগ-সুবিধা—এমন একটি ধারণা জনসাধারণের মধ্যে গেঁথে আছে। এই ধারণার কারণে তাঁদের প্রকৃত অর্থনৈতিক কষ্ট কেউ বুঝতে চায় না বা বিশ্বাস করতে চায় না। ফলে, নীরবে নিজেদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো উপায় থাকে না।

অপ্রত্যাশিত চাপ ও নীরব সংগ্রাম:

সরকারি কর্মচারীরা মনে করেন, তাঁদের বেতন যখন নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন জীবনযাত্রার ব্যয় আজকের মতো ছিল না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন বৃদ্ধি না হওয়ায় পরিবারের সকল চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাড়িভাড়া, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, চিকিৎসা ব্যয়—সব মিলিয়ে প্রতি মাসেই একটি বড় অঙ্কের ঘাটতি তৈরি হয়।

এই নীরব অর্থনৈতিক সংগ্রাম কেবল একটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি কর্মক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। আর্থিক দুশ্চিন্তা অনেক সময় একজন কর্মচারীর কর্মদক্ষতা ও মানসিক শান্তি কেড়ে নেয়।

গল্প শুধু আমি/আমরা জানি, যায় নাতো বলা:

প্রত্যেক কর্মচারীর জীবনে এমন একটি গল্প আছে, যা শুধু তিনি বা তাঁর পরিবার জানেন। হয়তো মাসের পর মাস একই জামা পরে অফিসে যাওয়া, প্রিয় খাবার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, কিংবা সন্তানের স্কুলের ফি দিতে হিমশিম খাওয়া। কিন্তু সামাজিক মর্যাদার কারণে এই কথাগুলো তাঁরা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেন না। “আমাদের গল্প শুধু আমরাই জানি, যা বলা যায় না”—এই বাক্যটিই যেন তাঁদের জীবনসংগ্রামের সারমর্ম।

দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দ্রুত পুনর্বিবেচনা করা—বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই সময়ের দাবি। নচেৎ, এই নীরব সংগ্রাম একসময় তীব্র অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে, যা একটি কার্যকর জনপ্রশাসনের জন্য শুভ নয়। সমাজেরও উচিত, তকমার আড়ালে থাকা এই মানুষগুলোর বাস্তব কষ্টকে অনুধাবন করা।

নিম্নগ্রেডের কর্মচারীর বেতন দিয়ে কি মাস চলে?

না, বর্তমান বাজারে নিম্নগ্রেডের কর্মচারীর বেতন দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা এবং মাস চালানো অত্যন্ত কঠিন, প্রায় অসম্ভব।

আপনার প্রশ্নে আপনি যে হতাশা প্রকাশ করেছেন, তা নিম্নগ্রেডের কর্মচারীদের জীবনের এক নির্মম বাস্তবতা।

কেন মাস চালানো কঠিন: একটি বাস্তব বিশ্লেষণ

জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ (যা এখনও কার্যকর) অনুসারে, সর্বনিম্ন গ্রেড (২০তম গ্রেড)-এর মূল বেতন শুরু হয় সাধারণত ৳৮,২৫০ টাকা থেকে (যদিও বিভিন্ন ভাতা যুক্ত হয়ে মোট বেতন আরেকটু বেশি হয়)।

মূল্যস্ফীতির কারণে এই সামান্য বেতনে একটি পরিবারকে (বিশেষ করে শহর অঞ্চলে) চলতে গিয়ে যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হতে হয়:

খরচের খাত বাস্তবতা (ঢাকাসহ বড় শহরের প্রেক্ষাপটে)
১. বাড়ি ভাড়া নিম্নগ্রেডের কর্মচারীর বেতনের একটি বিশাল অংশ চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। সরকারি বাসা না পেলে, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ঘর ভাড়া বাবদ ৳১০,০০০ থেকে ৳১৫,০০০ টাকা বা তারও বেশি খরচ হওয়া স্বাভাবিক। বেতনের চেয়েও বেশি টাকা শুধু ভাড়ায় চলে যায়।
২. খাদ্য ও পুষ্টি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত বাড়ছে। একটি চার সদস্যের পরিবারের মৌলিক খাদ্য খরচ মেটাতেই মাসে ৳১৫,০০০ থেকে ৳২০,০০০ টাকা বা তার বেশি প্রয়োজন হতে পারে।
৩. শিক্ষা ও চিকিৎসা সন্তানদের স্কুল ফি, খাতা-কলম, বইপত্র—সবকিছুর খরচ বহন করা কঠিন। সামান্য অসুস্থতা বা জরুরি চিকিৎসা খরচ হলেই ধার-দেনা করতে হয়। চিকিৎসা ভাতা (মাসিক ৳১৫০০-এর মতো) অপ্রতুল।
৪. যাতায়াত ও অন্যান্য ভাতা নিম্নগ্রেডের কর্মচারীরা যাতায়াত ভাতা (যেমন ৳৩০০) এবং টিফিন ভাতা (যেমন ৳২০০) পান, যা বর্তমানের পরিবহন খরচ বা টিফিনের খরচের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।

নিরন্তর সংগ্রাম:

বাস্তবতা হলো, নিম্নগ্রেডের কর্মচারীদের মাসের পর মাস চলতে হয় অন্যান্য উপার্জনের ওপর নির্ভর করে অথবা ঋণ করে

  • অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা: অনেকে ছুটির পর বা অফিস টাইমের বাইরে অতিরিক্ত কাজ (যেমন টিউশনি, পার্টটাইম কাজ) করে সংসার চালান।
  • পরিবারের ত্যাগ: অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রীকে কাজ করতে হয় বা সন্তানদের ভালো শিক্ষা বা আবদার ত্যাগ করতে হয়।
  • সামাজিক চাপ: আপনার বলা সেই “সরকারি চাকরি করেন, আপনার অভাব নেই”—এই ভুল ধারণার কারণে তাঁরা কারও কাছে নিজেদের কষ্টের কথা বলতে বা সাহায্য চাইতে পারেন না।

এই কারণেই সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নের এবং বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সর্বনিম্ন মূল বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির জোরালো দাবি উঠেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই বেতনে মাস চালানো কেবল কঠিন নয়, এটি তাঁদের মৌলিক অধিকার ও সম্মানের পরিপন্থী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *