৯ম পে স্কেল 2025 । নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের মূল দাবি—বেতনের অনুপাত ১:৪/১:৫-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা
নবম জাতীয় বেতন স্কেলের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫ যখন বিভিন্ন পক্ষের মতামত সংগ্রহ করছে, তখন নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে একটি কৌশলগত ও সুস্পষ্ট দাবি জোরদার হচ্ছে। তাঁদের মূল ফোকাস এখন আর গ্রেড সংখ্যা কমানো বা সর্বোচ্চ গ্রেডের বেতন নির্ধারণ নয়, বরং সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত একটি যৌক্তিক সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা।
কর্মচারীদের এই অংশটি মনে করছে, পে স্কেলে গ্রেড বিভাজন কিংবা সর্বোচ্চ গ্রেডের বেতন কত হবে—তা নিয়ে বেশি চিন্তা না করে, তাঁদের সব শক্তি কেন্দ্রীভূত করা উচিত বেতনের অনুপাত ১:৪ বা ১:৫-এর মধ্যে রাখার দাবিতে।
অনুপাত ১:৫-এর মধ্যে রাখার কৌশল কেন?
বর্তমানে সরকারি বেতন কাঠামোর সর্বনিম্ন (গ্রেড-২০) ও সর্বোচ্চ (গ্রেড-১) মূল বেতনের অনুপাত প্রায় ১:১০। এই বিশাল বৈষম্যই নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।
নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা যুক্তি দিচ্ছেন যে, যদি বেতনের অনুপাত ১:৪ বা ১:৫-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, তবে সর্বোচ্চ গ্রেডের (কর্তাদের) বেতন যত বেশিই নির্ধারণ করা হোক না কেন, এর সরাসরি ও ইতিবাচক প্রভাব নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বেতনের উপর পড়বে।
উদাহরণস্বরূপ:
- যদি সর্বোচ্চ বেতন টাকা হয় এবং অনুপাত ১:৫ হয়, তবে সর্বনিম্ন বেতন হবে টাকা।
- যদি সর্বোচ্চ বেতন টাকা হয় এবং অনুপাত ১:৫ হয়, তবে সর্বনিম্ন বেতন হবে টাকা।
এই কৌশলের পক্ষে থাকা কর্মচারীরা বলছেন, এতে করে কর্তারা নিজেদের বেতন যত বাড়াতে চাইবেন, আনুপাতিকভাবে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বেতনও ততটা বাড়াতে বাধ্য হবেন, যা উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হতে পারে। এর ফলে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীর মূল বেতন একটি সম্মানজনক পর্যায়ে উন্নীত হবে, যা বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য।
সোচ্চার হওয়ার আহ্বান
বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে—তাঁরা যেন দ্রুত paycommission2025.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে তাঁদের অনলাইন মতামতে এই ১:৪ বা ১:৫ অনুপাতের পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন।
কর্মচারীরা মনে করেন, “গ্রেড সংখ্যা কতটা হলো বা কর্তারা কত পেলেন—তা নিয়ে আমাদের সমস্যার থেকে, আমাদের জীবনধারণের জন্য পর্যাপ্ত নূন্যতম বেতন নিশ্চিত করাটা বেশি জরুরি। আর অনুপাত সীমিত রাখলে, সেই লক্ষ্য অর্জন করা সহজ হবে।”
জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫ আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সর্বসাধারণের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ শেষ করবে। ফলে, অনুপাত সীমিত রাখার এই দাবি কতটা শক্তিশালী জনমত তৈরি করতে পারে এবং তা কমিশনের সুপারিশে স্থান পায় কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
নবম বেতন কমিশনকে ঘিরে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন একটি পুরোনো যুক্তি সামনে আসছে: সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়লে বাজারে জিনিসের দাম বাড়ে (মূল্যস্ফীতি)। নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা এই যুক্তিকে একপেশে এবং বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছেন।
১৫ লক্ষ সরকারি কর্মচারী বনাম ২০ কোটি জনগণ
মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধিকে দায়ী করা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষ সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা (প্রায় ২০ কোটি ধরে) বিবেচনা করলে, সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি একটি বহুমুখী ও জটিল সমস্যা, যা আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের দাম, দেশের মুদ্রা বিনিময় হার, জ্বালানি তেলের মূল্য এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহের মতো অনেক বড় অর্থনৈতিক সূচকের ওপর নির্ভরশীল। অর্থনীতিবিদদের মতে, ১ শতাংশেরও কম জনগোষ্ঠীর বেতন বৃদ্ধির কারণে পুরো দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটবে—এই সরলীকরণ বাস্তবসম্মত নয়।
তাঁরা বলছেন, বড় ধরনের অবকাঠামো প্রকল্প, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ এবং বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সিন্ডিকেটই মূল্যস্ফীতির মূল চালিকাশক্তি।
উচ্চ গ্রেডে কতজন কর্মকর্তা? বৈষম্যের সংজ্ঞা কী?
বেতন কমিশন প্রসঙ্গে কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ বিবাদেও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। গ্রেড ১ থেকে ৪ পর্যন্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বেতনের সঙ্গে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বেতনের বিশাল ব্যবধান নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ।
উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তাদের সংখ্যা প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট সরকারি তথ্য সবসময় প্রকাশ করা না হলেও, গ্রেড ১, ২, ৩ এবং ৪ এ থাকা কর্মকর্তার সংখ্যা মোট কর্মচারীর সংখ্যার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
কর্মচারীদের একাংশ মনে করছে, নিজেদের মধ্যে গ্রেডভিত্তিক ‘হিংসা’ করে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা নিজেদের ক্ষতি করছেন। তাঁদের মতে, বৈষম্যের মূল কারণ উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তাদের প্রতি হিংসা নয়, বরং যোগ্যতা, দক্ষতা এবং দায়িত্বের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বেতনের ক্ষেত্রে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘অমানবিক’ ব্যবধান থাকা।
‘যোগ্যতা অর্জন করুন, অন্যের প্রতি হিংসা নয়’
বেতন কাঠামো নিয়ে চলা বিতর্কে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের উদ্দেশে কঠোর বার্তা দেওয়া হচ্ছে: “বিনা যোগ্যতায় অন্যের প্রতি হিংসা করে নিজেদের আরো নিচে নামাবেন না।”
তাঁদের মতে, উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তারা কঠোর প্রতিযোগিতা ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা পার করে এসেছেন। নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের উচিত অন্যের প্রাপ্তি নিয়ে মনঃকষ্টে না ভুগে, নিজস্ব যোগ্যতা, দক্ষতা এবং কর্মজীবনের উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া। তাঁদের আরও অভিযোগ, নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা শুধুমাত্র গ্রেড সংখ্যা বা অনুপাত নিয়ে অযৌক্তিক চিৎকার করলে, তাঁরা “যেখানে আছেন, সেখানেই থেকে যাবেন”—অর্থাৎ, বর্তমান কাঠামোগত দুর্বলতা দূর হবে না।
সবমিলিয়ে, নবম পে স্কেল শুধু বেতন বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব নয়, এটি সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, যোগ্যতা ও দক্ষতা, এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মতো মৌলিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর ওপরও প্রশ্ন তুলছে। কমিশনকে এমন একটি সমাধান আনতে হবে, যা সকল গ্রেডের কর্মচারীর জন্য ন্যায্য এবং দেশের অর্থনীতির জন্য টেকসই হয়।