Friday, October 10, 2025
Latest:
সর্বশেষ প্রকাশিত

নতুন পে-কমিশনে তোড়জোড় ২০২৫ । কর্মচারীদের দাবীনামা ও অনলাইন মতামত নিয়ে বিতর্ক?

নতুন পে-কমিশনকে কেন্দ্র করে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। একাধিক কর্মচারী সংগঠন দ্রুত তাদের দাবীনামা পেশ করতে এবং কর্মচারীদের প্রতি অনলাইনে মতামত দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। তবে এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিফলন নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যেই তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও সংশয়। কর্মচারী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে যে পে-কমিশনের কার্যক্রম দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে এবং তারা আশা করছেন, এবার সরকারি কর্মীদের জন্য ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ একটি পে-স্কেল প্রণীত হবে।

অনলাইন মতামত: ‘জনগণের নাম ব্যবহারের কৌশল’ নাকি ‘বাস্তব প্রতিফলন’?

পে-কমিশনের প্রক্রিয়ায় কর্মচারীদের অনলাইন মতামত আহ্বান করার বিষয়টি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন কয়েকজন কর্মচারী নেতা ও বিশ্লেষক।

কর্মচারী নেতা তৌহিদুল আলম এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে ‘বোগাস’ বা ভিত্তিহীন বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, “আমার কাছে মনে হয় এই ব্যাপারটা বোগাস। সরকার তার মন মতোই পে-কমিশনকে দিয়ে পে-স্কেল প্রণয়ন করবে। আর বলবে, জনগণের অনলাইনের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই এই পে-স্কেল দেওয়া হয়েছে।” তার মতে, কর্মচারী বা জনগণের মতামতের চেয়ে সরকারের নিজস্ব পরিকল্পনাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

অন্যদিকে, আরেক কর্মচারী নেতা আশিকুল ইসলাম আশাবাদী। তিনি তৌহিদুল আলমের বক্তব্যকে ‘ভুল’ বলে উল্লেখ করে বলেন, “এটা ভুল। এই সরকার পে-স্কেল বাস্তবায়ন করবে। তবে ওপরের গ্রেড আর নিম্ন গ্রেডের পার্থক্য বিগত সময়ের চেয়ে ভালো হবে ইনশাআল্লাহ।” তার বিশ্বাস, নতুন পে-স্কেলে বেতন-বৈষম্য কমানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

কর্মচারীদের প্রতি জরুরি আহ্বান

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী সংগঠনের প্রতিনিধি জানান, যেহেতু কমিশন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কাজ করছে, তাই যে সকল কর্মচারী সংগঠন এখনও তাদের দাবীনামা জমা দেননি, তাদের দ্রুত তা পেশ করা উচিত। পাশাপাশি, ব্যক্তিগত কর্মচারীদেরও কমিশনের ওয়েবসাইটে তাদের মতামত ও প্রত্যাশা দ্রুত লিখে দেওয়া প্রয়োজন।

কর্মচারী মহল আশা করছে, কমিশনের এই কর্মতৎপরতা শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তাদের সুবিধা না দেখে, নিম্ন ও মধ্যম গ্রেডের কর্মচারীদের জীবনযাত্রার ব্যয় এবং বেতন বৈষম্যের মতো মৌলিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পে-স্কেল উপহার দেবে।

সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো সুপারিশ করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি জাতীয় পে কমিশন ২০২৫ (National Pay Commission 2025) গঠন করেছে। প্রায় এক দশক পর নতুন পে-কমিশন গঠন করা হলো।

১. কমিশনের লক্ষ্য ও নির্দেশনা

সরকারের মূল লক্ষ্য একটি সময়োপযোগী, ন্যায্য, এবং বাস্তবসম্মত বেতন কাঠামো তৈরি করা, যা বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন নতুন কাঠামোটি বর্তমান মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।

কমিশনের কাজের পরিধির মধ্যে প্রধানত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  • বেতন ও ভাতা পর্যালোচনা: সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পর্যালোচনা করা।
  • বেতন বৈষম্য নিরসন: গ্রেড ও ইনক্রিমেন্টে বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করার সুপারিশ করা।
  • বিশেষায়িত পে-স্কেল: বিশেষায়িত পেশার (যেমন ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ) জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরির সুপারিশ করা।
  • ভাতা ও সুবিধা: বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, যাতায়াত, শিক্ষা ভাতা, এবং অবসর ও পেনশন সুবিধার সময়োপযোগী সংস্কার আনা।
  • মুদ্রাস্ফীতির সাথে সমন্বয়: মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বেতনের সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি নির্ধারণ করা, যা আগে আলোচিত হয়নি।
  • স্বাস্থ্য বীমা: প্রধান উপদেষ্টা সরকারি কর্মীদের জন্য একটি স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা চালুর ওপর জোর দিয়েছেন, যা কমিশনের সুপারিশমালায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

২. পে-কমিশনের কাজের অগ্রগতি ও সময়সীমা

জাতীয় পে কমিশন ২০২৫-এর চেয়ারম্যান ও সাবেক অর্থ সচিব জাকির আহমেদ খান জানিয়েছেন, কমিশন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কাজ শুরু করেছে।

  • দ্রুত রিপোর্ট প্রদান: কমিশনকে প্রাথমিকভাবে ছয় মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। তবে চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, তারা নির্ধারিত সময়ের আগেই রিপোর্টটি চূড়ান্ত করার আশা করছেন।
  • বাস্তবায়নের সময়: অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, নতুন পে-স্কেল ২০২৬ সালের প্রথম দিক (জানুয়ারি) থেকেই কার্যকর করার জন্য সরকার গেজেট প্রকাশ করতে পারে।

৩. সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণ

এই বেতন কাঠামোটিকে আরও গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর করার জন্য সরকার প্রথমবারের মতো সাধারণ জনগণ এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মতামত জানতে চেয়েছে।

  • অনলাইন জরিপ: কমিশনের ওয়েবসাইটে (paycommission2025.gov.bd) সরকারি কর্মচারী, সাধারণ জনগণ, প্রতিষ্ঠান এবং অ্যাসোসিয়েশন—এই চারটি ক্যাটাগরির জন্য আলাদা অনলাইন প্রশ্নমালা দেওয়া হয়েছে। (এই মতামত দেওয়ার শেষ সময় ছিল সাধারণত ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত)।
  • নূন্যতম বেতনের প্রশ্ন: সাধারণ জনগণের জন্য প্রশ্নমালায় একটি ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য একজন সরকারি কর্মচারীর ন্যূনতম মূল বেতন কত হওয়া উচিত—সে বিষয়েও মতামত চাওয়া হয়েছে।

সরকারের এই পদক্ষেপ নির্দেশ করে যে তারা একটি সামগ্রিক এবং বাস্তবসম্মত পে-স্কেল প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারি কর্মীদের অর্থনৈতিক দুর্দশা লাঘব করতে এবং পে-স্কেলের দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূর করতে আগ্রহী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *