জাতীয় পে কমিশন ২০২৫ । সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করার প্রস্তাব, সর্বনিম্ন বেতন ২৫,৮০০ টাকা!
বেতন কাঠামো সংক্রান্ত প্রধান প্রস্তাবনা- জাতীয় বেতন স্কেল ২০২৫ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
১. গ্রেড ও পদভিত্তিক প্রস্তাব
-
গ্রেডের সংখ্যা: বিদ্যমান ২০টি গ্রেড (১-২০) অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
এন্ট্রি পদের গ্রেড: বিদ্যমান গ্রেড ২০-০৯ এর পরিবর্তে প্রস্তাবিত এন্ট্রি পদের গ্রেড ২০, ১৮, ১৬, ১৪, ১২, ১০, ৯, ৭ করার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
ক্যাডার পদের এন্ট্রি গ্রেড ৭ম এবং অন্যান্য ৯ম গ্রেডের এন্ট্রি গ্রেড ৯ম করার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
-
পদোন্নতি: একটি অভিন্ন ও সুনির্দিষ্ট পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
সকল কর্মচারীর জন্য কমপক্ষে ৪টি পদোন্নতির সুযোগ রাখা এবং পদোন্নতির জন্য সুনির্দিষ্ট ‘প্রমোশন ট্রি’ (Promotion Tree) রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
-
ন্যূনতম চাকরিকাল অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে প্রথম পদোন্নতির জন্য ৫ বছর চাকুরিকাল নির্ধারণ করা যেতে পারে ।
-
২. নতুন বেতন স্কেল
-
ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর: ২০১৫ সালের অষ্টম পে স্কেলে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ১.৮৮-২.০১ । প্রস্তাবিত নবম পে স্কেলে (২০২৫) এটি ২.১২-৩.১২ ধরার সুপারিশ করা হয়েছে ।
-
প্রস্তাবিত বেতন: ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.১২-৩.১২ ধরে ২০তম গ্রেডে সর্বনিম্ন বেতন ২৫,৮০০ টাকা এবং ১ম গ্রেডে সর্বোচ্চ বেতন ১,৬৫,৫০০-১,৮০,৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
বর্তমানে ২০তম গ্রেডে সর্বনিম্ন বেতন ৮,২৫০ টাকা এবং ১ম গ্রেডে সর্বোচ্চ বেতন ৭৮,০০০ টাকা (নির্ধারিত) ।
-
-
বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট: সকল গ্রেডের জন্য বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের হার ৫% না রেখে, এটি নির্ধারিত পরিমাণ ৩,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির বৈষম্য দূর করবে ।
-
জুলাই মাসের ০১ তারিখ থেকে ইনক্রিমেন্ট কার্যকর হবে ।
-
৩. উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো
-
উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের জন্য স্বতন্ত্র উচ্চতর বেতন কাঠামো করার প্রস্তাব করা হয়েছে, কারণ অন্যান্য দেশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করা সিভিল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র অবস্থান ও উচ্চতর স্কেল প্রদান করা হয় ।
-
সুপার গ্রেড (সচিব) এর প্রস্তাবিত বেতন ১,৭৫,৫০০-১,৮৭,৫০০ টাকা এবং স্পেশাল গ্রেড (মুখ্য সচিব ও ক্যাবিনেট সচিব) এর বেতন ১,৯৫,০০০ টাকা (নির্ধারিত) করার প্রস্তাব করা হয়েছে (প্রস্তাব ১ অনুযায়ী) ।
ভাতা ও আর্থিক সুবিধাদির প্রস্তাবনা
সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন ভাতা ও সুবিধাদি বৃদ্ধিরও সুপারিশ করা হয়েছে:
-
চিকিৎসা ভাতা:
-
সরকারি কর্মচারী ও ৬৫ বছরের কম বয়সী অবসরভোগীদের মাসিক ১৫০০ টাকার পরিবর্তে ৫,০০০ টাকা ।
-
৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী অবসরভোগীদের মাসিক ২৫০০ টাকার পরিবর্তে ৭,৫০০ টাকা ।
-
প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে কর্মচারী ও ৬৫ বছরের কম বয়সী অবসরভোগীদের মাসিক ১০,০০০/- টাকা এবং ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্বদের জন্য ১২,৫০০/- টাকা চিকিৎসা ভাতা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
এছাড়া, চিকিৎসা ভাতার পাশাপাশি সরকার ও কর্মচারীর যৌথ অর্থায়নে স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা এবং জীবন বীমার আওতায় আনার অথবা ৫০,০০০ টাকা বাৎসরিক লিমিটসহ ক্যাশলেস হেলথ কার্ড প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
-
যাতায়াত ভাতা:
-
সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কর্মরত গ্রেড ১১-২০ এর কর্মচারীদের বিদ্যমান মাসিক ৩০০ টাকার পরিবর্তে ১,৫০০ টাকা ।
-
বেতন গ্রেড-১০ এর কর্মচারীদের যাতায়াত ভাতার প্রাপ্যতায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ১,০০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
-
বাড়ি ভাড়া ভাতা:
-
বর্তমান বাড়ি ভাড়া ভাতার কাঠামো পরিবর্তন করে এটিকে দু’টি নতুন ভাতায় রূপান্তর করা যেতে পারে: ১) বাড়ি ভাড়া ভাতা- ২০% এবং ২) জীবনযাপন ভাতা- ৪০% ।
-
সরকারি আবাসনে বসবাসকারী সকল কর্মচারীকে বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রদানের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনকে ব্যয়বহুল এলাকা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে ।
-
৪. পেনশন ও গ্র্যাচুইটি
-
অবসরভোগী/পেনশনভোগীদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটির হার পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
পেনশনের বিদ্যমান হার ২১%-৯০% এর পরিবর্তে ২৩%-১০০% করার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
গ্র্যাচুইটির বিদ্যমান হার ২৬৫/২৬০/২৪৫/২৩০ গুণ এর পরিবর্তে ৩০০/২৯০/২৮০/২৭০ গুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
২৫ বছর ও তার ঊর্ধ্বে পেনশনযোগ্য চাকরিকালের জন্য পেনশনের হার শেষ বেতনের ১০০% করার সুপারিশ করা হয়েছে ।
-
স্বেচ্ছায় অবসর গমনের চাকরিকাল ১৫ বছর এবং বাধ্যতামূলক অবসরের চাকরিকাল ২৫ বছর করার উল্লেখ করা হয়েছে ।
-
পরিবর্তনের পটভূমি
২০১৫ সালের অষ্টম পে স্কেলের পর ইতোমধ্যে ১০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত প্রায় ছয় বছর পর পর নতুন পে স্কেল প্রণয়ন করা হয়, ফলে ২০২১ সালে নবম পে স্কেল চালু হওয়া উচিত ছিল । বিগত দশ বছরে মূল্যস্ফীতির হার (২০১৫ সালে ৬.৪১% থেকে ২০২৫ সালে ৯.৯৮% হয়েছে) এবং জীবনযাত্রার ব্যয় (যেমন চালের দাম ১.৮৫-২.০ গুণ, গরুর মাংসের দাম ২.১৫ গুণ বেড়েছে) উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি কর্মচারীগণ দুর্বিষহ দিনাতিপাত করছেন । এই প্রেক্ষাপটে, বাজার ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি যৌক্তিক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা জরুরি ।

জাতীয় পে কমিশন ২০২৫ পূর্নাঙ্গ প্রস্তাব
নতুন প্রস্তাব কি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য দূর করবে?
হ্যাঁ, জাতীয় পে কমিশন, ২০২৫-এর নতুন প্রস্তাবনায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য কমানোর বা দূর করার সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা রয়েছে । প্রধানত দুটি ক্ষেত্রে এই বৈষম্য দূর করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে:
১. বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট (Annual Increment)
বিদ্যমান ব্যবস্থায় সকল গ্রেডের কর্মচারীর জন্য বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার ৫% থাকায়, নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে যৌক্তিক হারে বেতন বৃদ্ধি হয় না ।
প্রস্তাবিত পরিবর্তন:
-
নির্ধারিত ইনক্রিমেন্ট: বার্ষিক ইনক্রিমেন্টকে শতাংশের পরিবর্তে নির্ধারিত পরিমাণ ৩,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
বৈষম্য হ্রাস: এর ফলে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির বৈষম্য দূর হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।
উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ২০তম গ্রেডের কর্মচারীর মূল বেতন ১০,০০০ টাকা হয়, তবে ৫% ইনক্রিমেন্টে তার বেতন বাড়বে ৫০০ টাকা। অন্যদিকে, একজন ৯ম গ্রেডের কর্মচারীর মূল বেতন ৪০,০০০ টাকা হলে, ৫% ইনক্রিমেন্টে তার বেতন বাড়বে ২,০০০ টাকা। প্রস্তাবিত ৩,০০০ টাকার নির্ধারিত ইনক্রিমেন্ট কার্যকর হলে, এই উভয় কর্মচারীই সমান ৩,০০০ টাকা ইনক্রিমেন্ট পাবেন, যা নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য বেশি আনুপাতিক সুবিধা দেবে।
২. এন্ট্রি গ্রেড এবং পদোন্নতি
গ্রেডভিত্তিক শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড আরও শক্তিশালী করা এবং সকল গ্রেডের কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সমান/ন্যায্য সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ।
প্রস্তাবিত পরিবর্তন:
-
এন্ট্রি গ্রেড: গ্রেডভিত্তিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এন্ট্রি পদের গ্রেড ২০-০৯ এর পরিবর্তে ২০, ১৮, ১৬, ১৪, ১২, ১০, ৯, ৭ করার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
অভিন্ন পদোন্নতি নীতিমালা: পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিদ্যমান অভিন্ন ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব দূর করে একটি অভিন্ন ও সুনির্দিষ্ট পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
পদোন্নতির সুযোগ:
-
যে পদেই যোগদান হোক না কেন, পদোন্নতির সংখ্যা ৪/৫/৬ টি (অন্তত ৪ টি) করার প্রস্তাব করা হয়েছে ।
-
সকল গ্রেডের কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ‘প্রমোশন ট্রি’ (Promotion Tree) থাকবে ।
-
কোনো ধরনের ব্লক পোস্ট থাকবে না । এর অর্থ হলো, ড্রাইভারের মতো ব্লক পোস্টে যোগদানকারী কর্মচারীও পদোন্নতি পেয়ে গ্রেড ১৬ পর্যন্ত যেতে পারবেন ।
-
এই পদক্ষেপগুলো নিশ্চিত করবে যে নিম্ন গ্রেড থেকে আসা কর্মচারীরাও তাদের সমগ্র চাকরি জীবনে ন্যায্য সংখ্যক পদোন্নতি এবং বেতন বৃদ্ধির সুযোগ পাবেন, যা বিদ্যমান বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে ।

