সর্বশেষ প্রকাশিত

নবম পে-স্কেলে বৈষম্য দূরীকরণের আহ্বান ২০২৫ । দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে কর্মচারী মহলে আশার সঞ্চার হয়েছে?

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নবম পে-কমিশন গঠনকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন কর্মচারীরা। একই সাথে, তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বেতন স্কেল চূড়ান্ত করে, বিশেষত বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে, আগামী ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে এটি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।

গত জুলাই মাসে সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার নবম জাতীয় বেতন কমিশন-২০২৫ গঠন করে, এবং কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এই পদক্ষেপ সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আশার সঞ্চার করেছে।

তবে, কর্মচারীরা এখন কমিশনের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তাদের মূল দাবি হলো, বেতনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের অনুপাত (ratio) ১:৪ নির্ধারণ করে, ১২টি গ্রেডে নতুন বেতন স্কেল প্রণয়ন করা। তারা মনে করছেন, এটি কার্যকর হলে বেতন কাঠামোতে বিদ্যমান বহু বৈষম্যের অবসান ঘটবে এবং সাধারণ কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।

বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ একমত পোষণ করে জানিয়েছেন, দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং সীমিত বেতন কাঠামোতে জীবনযাপন করা সাধারণ কর্মচারীদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, নবম পে-কমিশনকে অবশ্যই একটি ‘কর্মচারীবান্ধব’ বেতন স্কেল প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে।

এক বিবৃতিতে কর্মচারীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “নবম পে-কমিশন গঠন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আমাদের দাবি অনুযায়ী দ্রুত ১:৪ অনুপাতে ১২টি গ্রেডে বেতন স্কেল করে সকল বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে আগামী ডিসেম্বর/২০২৫ এর মধ্যে পে-স্কেল বাস্তবায়ন করে আরও একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক স্থাপন করবে। দ্রুত বাস্তবায়ন হলেই এটি সাধারণ কর্মচারীদের কাছে সরকারের একটি বিরাট উপহার হিসেবে বিবেচিত হবে।”

কর্মচারীদের এই দাবি পূরণে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, এখন সেদিকেই তাকিয়ে আছে সরকারি চাকরিজীবী মহল। আশা করা হচ্ছে, কমিশনের প্রতিবেদন দ্রুত তৈরি হবে এবং সরকার আগামী বছরের শুরুতেই নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি করবে। নবম পে-কমিশন গঠন প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল উদ্দেশ্যগুলো হলো:

১. নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ: সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি নতুন বেতন কাঠামো (নবম পে-স্কেল) নির্ধারণ করা। (সর্বশেষ বেতন স্কেল ২০১৫ সালে বাস্তবায়িত হয়েছিল।)

২. উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা: গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং তাদের কাজে উৎসাহ দেওয়া।

৩. বেতন বৈষম্য দূরীকরণ: বিদ্যমান বেতন কাঠামোতে (অষ্টম পে-স্কেল, ২০১৫) যে অসংগতি বা বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা দূরীকরণের জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করা। বিশেষ করে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করে বৈষম্য কমানোর প্রত্যাশা রয়েছে।

৪. কমিশনের কর্মপরিধিতে গুরুত্ব দেওয়া বিষয়সমূহ: কমিশনকে যেসব বিষয় বিবেচনা করে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে: * পিতা-মাতাসহ একটি পরিবারের (অনূর্ধ্ব ছয়জন) জীবনযাত্রার ব্যয়। * অনূর্ধ্ব দুই সন্তানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়। * দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সরকারের সম্পদ পরিস্থিতি। * জনপ্রশাসনে মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও কর্মোদ্যোগ বৃদ্ধি করে সেবার মান উন্নয়ন।

৫. দ্রুত প্রতিবেদন গ্রহণ: সরকার সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে।

৬. বিশেষ প্রণোদনা প্রদান: নবম পে-স্কেল চূড়ান্ত হওয়ার আগে থেকেই সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সৃষ্ট চাপ মোকাবিলায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ প্রণোদনা (যা ৫% থেকে বাড়ানো হয়েছে) প্রদান করছে।

সংক্ষেপে, সরকার মূলত বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি যৌক্তিক, ন্যায্য এবং কর্মচারীবান্ধব নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে চায়, যা অর্থনৈতিক সক্ষমতা বজায় রেখে সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং তাদের কাজে আরও উৎসাহী করে তুলবে।

নবম জাতীয় বেতন কমিশন-২০২৫ (৯ম পে-স্কেল) নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সুপারিশ বা গেজেট জারি না হলেও, কমিশন এবং সংশ্লিষ্টদের আলোচনা থেকে নতুন কাঠামো কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়।

নতুন বেতন কাঠামোতে যে পরিবর্তনগুলো আসতে পারে, সেগুলোর মধ্যে প্রধান হলো:

১. বেতন বৃদ্ধি ও অনুপাত (Ratio)

নতুন পে-স্কেলে মূল বেতন প্রায় দ্বিগুণ করার একটি জোরালো আলোচনা আছে। মূল্যস্ফীতি এবং দীর্ঘ ১০ বছরের ব্যবধান বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

বিষয় বর্তমান (৮ম পে-স্কেল, ২০১৫) সম্ভাব্য নতুন (৯ম পে-স্কেল)
সর্বোচ্চ মূল বেতন (১ম গ্রেড) ৭৮,০০০ টাকা প্রায় ১,৫৬,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
সর্বনিম্ন মূল বেতন (২০তম গ্রেড) ৮,২৫০ টাকা ১৬,৫০০ থেকে ₹৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রস্তাব বা আলোচনায় আছে।
সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত প্রায় ১০:১ ৮:১ থেকে ১০:১ এর মধ্যে বহাল থাকার সম্ভাবনা বেশি। (কর্মচারীরা ১:৪ এর দাবি জানালেও কমিশন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কাঠামো পর্যালোচনা করে এই অনুপাত বজায় রাখতে পারে।)

২. গ্রেড সংখ্যা হ্রাস

বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ২০টি গ্রেড রয়েছে। পে-কমিশন গ্রেড সংখ্যা কমানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে।

  • সম্ভাব্য গ্রেড সংখ্যা: ২০টি গ্রেড ভেঙে ১২টি বা ১৫টি গ্রেডে নামিয়ে আনার প্রাথমিক আলোচনা চলছে।
  • উদ্দেশ্য: গ্রেড কমানো হলে বেতন কাঠামোতে বিদ্যমান জটিলতা ও বৈষম্য অনেকাংশে কমে আসবে এবং গ্রেডগুলোর মধ্যে বেতনের পার্থক্য আরও সুষম হবে।

৩. ভাতাদি ও অন্যান্য সুবিধা

মূল বেতনের পাশাপাশি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পুনর্বিবেচনা করে বাড়ানো হতে পারে:

  • চিকিৎসা ভাতা: বর্তমানে কর্মচারীরা চাকরির শুরু থেকে অবসর পর্যন্ত মাসে ₹১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। কমিশন এটি বাড়ানোর পাশাপাশি অবসরোত্তর সময়ের জন্যও বাড়তি সুবিধা রাখার পরিকল্পনা করছে।
  • শিক্ষা ভাতা: সন্তানদের শিক্ষা ভাতাও বাড়ানোর সুপারিশ থাকবে।
  • টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড: যদিও সর্বশেষ পে-স্কেলে (২০১৫) এই সুবিধাগুলো বাতিল করা হয়েছিল, পদোন্নতি না হলে কর্মচারীরা যাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য উচ্চতর গ্রেড বা অন্য কোনো সুবিধাকে আরও সহজ করার প্রস্তাব আসতে পারে।

৪. বাস্তবায়নের সময়সীমা

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, নবম জাতীয় বেতন স্কেল অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই গেজেটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। এটি ২০২৬ সালের শুরু (জানুয়ারি/মার্চ/এপ্রিল) থেকেই কার্যকর হতে পারে।

নতুন পে-স্কেলের চূড়ান্ত রূপরেখা কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরই জানা যাবে, তবে সামগ্রিক আলোচনা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এটি একটি বৈষম্যমুক্ত ও বাস্তবসম্মত বেতন কাঠামো হবে, যা মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *