দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস, সরকারি কর্মচারীদের বৈষম্যহীন নতুন পে-স্কেলের জরুরি দাবি
বর্তমানে আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়া কর্মচারীদের পক্ষ থেকে দ্রুত একটি বৈষম্যহীন নতুন জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা ও পে-কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সকল সদস্যের প্রতি জরুরি আবেদন জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক চিঠিতে (প্রেরক: স্ক রফিকুল ইসলাম) সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে এই দাবিগুলো জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়। চিঠিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে “নুন আনতে পান্তা ফুরায়” এমন অবস্থা হয়েছে বহু সরকারি চাকরিজীবীর।
মূল দাবিগুলো যা রয়েছে
চিঠিতে নতুন পে-স্কেল প্রণয়নে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট ও বৈপ্লবিক প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে, যা নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জীবনযাত্রায় স্বস্তি এনে দিতে পারে:
- বেসিক বেতনের অনুপাত নির্ধারণ: সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেসিকের অনুপাত ১:৪ করার দাবি জানানো হয়েছে।
- গ্রেড সংখ্যা হ্রাস: বর্তমানে বিদ্যমান ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১২টি গ্রেড প্রবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা বেতন বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে।
- সমান গ্রেড ব্যবধান: সকল গ্রেডের মধ্যে বেতনের ব্যবধান সমান রাখার দাবি জানানো হয়েছে।
- সর্বনিম্ন বেসিক বেতন: জীবনযাত্রার ব্যয়ভার মেটাতে সর্বনিম্ন বেসিক বেতন ৩৫,০০০/- (পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা) নির্ধারণের দাবি জানানো হয়েছে।
- সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি: বেতনের পাশাপাশি শিক্ষাবাতা, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, ধুলাই ভাতা, টিফিন বা দুপুরে লাঞ্চ ভাতা, উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি এবং রেশনিং ব্যবস্থা চালুর মতো সময়োপযোগী সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হয়েছে।
দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা
চিঠিতে অতীতে দীর্ঘ দশ বছরে দুটি পে-স্কেল থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে কর্মচারীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন, অতীতের সকল বৈষম্য ভুলে গিয়ে নতুন আঙ্গিকে একটি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেতন কাঠামো সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছে।
কর্মচারীরা আশা করছেন, সরকার তাদের এই যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ করে এমন একটি পে-স্কেল উপহার দেবে, যা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী “নতুন বাংলাদেশকে” চিরস্মরণীয় করে রাখবে। এই পদক্ষেপটি সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা তৈরি করবে বলেও পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠির শেষে প্রধান উপদেষ্টা পরিষদ ও পে-কমিশনের সকল সদস্যকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ১:৪ অনুপাতে বেতন এবং ১২টি গ্রেড প্রবর্তনের দাবি উঠলেও, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং পে-কমিশনের সদস্যদের বক্তব্যে বৈষম্য দূর না হওয়ার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কর্মচারীদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নিয়েছে যে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (আমলা ও সচিব) মহলের সন্তুষ্টির জন্যই মূলত বিদ্যমান বেতন বৈষম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
১. ‘১:১০ অনুপাত’ বহাল রাখার ইঙ্গিত
পে-কমিশনের সদস্যদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নতুন বেতন কাঠামোতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত বিদ্যমান ১০:১-এর কাছাকাছি অর্থাৎ ৮:১ থেকে ১০:১-এর মধ্যে রাখার চিন্তা করা হচ্ছে।
- কর্মচারীদের দাবি ছিল: ১:৪ অনুপাত, যা বৈষম্য ব্যাপকভাবে কমাতো।
- কমিশনের ইঙ্গিত: ৮:১ থেকে ১০:১ অনুপাত বহাল রাখা, যার অর্থ নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীর তুলনায় উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তার বেতন প্রায় ৮ থেকে ১০ গুণ বেশিই থাকবে।
এই অনুপাত বজায় রাখার যুক্তি হিসেবে কমিশন প্রতিবেশী দেশগুলোতেও একই ধরনের অনুপাত থাকার কথা উল্লেখ করেছে। তবে, কর্মচারীরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সবার জন্য সমান হলেও, বেতনের এই বিপুল ব্যবধান নিম্ন আয়ের কর্মীদের জন্য চরম বৈষম্য তৈরি করবে।
২. ২০টি গ্রেড বহাল থাকার আশঙ্কা
যদিও গ্রেড সংখ্যা ২০টি থেকে কমিয়ে ১৫টি বা ১২টি করার প্রাথমিক আলোচনা চলছে বলে খবর এসেছে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া এবং ১:১০ অনুপাত বহাল রাখার ইঙ্গিতের ফলে কর্মচারীদের আশঙ্কা—শেষ পর্যন্ত ২০টি গ্রেডই অপরিবর্তিত বা সামান্য পরিবর্তিত আকারে বহাল রাখা হতে পারে। ২০টি গ্রেড বহাল থাকলে নিম্ন গ্রেডগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও বৈষম্য থেকেই যাবে।
৩. বৈষম্য ধরে রাখার কারণ: আমলাদের প্রভাব
সরকারি কর্মচারীদের নিম্ন গ্রেডগুলোর (১১-২০) নেতারা মনে করছেন, এই ১০:১ অনুপাত এবং গ্রেড কাঠামো ধরে রাখার মূল উদ্দেশ্য হলো আমলাতন্ত্র ও উচ্চপদস্থ সচিবদের খুশি রাখা। যদি ১:৪ অনুপাত কার্যকর করা হতো, তবে উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তারা আনুপাতিক হারে কম সুবিধা পেতেন, যা তারা মেনে নিতে প্রস্তুত নন। ফলে, এই বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের চাপ বা প্রভাব কাজ করছে বলে কর্মচারীদের অভিযোগ।
৪. অর্থ উপদেষ্টার অবস্থান
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বারবার বলেছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই নতুন পে-স্কেল গেজেট আকারে বাস্তবায়ন করা হবে এবং এর জন্য পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করা হবে না। যদিও তিনি দ্রুত বাস্তবায়নের আশ্বাস দিচ্ছেন, কিন্তু অনুপাত ও গ্রেড সংক্রান্ত কমিশনের ইঙ্গিতগুলো কর্মচারী সংগঠনগুলোর ‘বৈষম্যহীন’ বেতন কাঠামোর দাবির বিপরীতে যাচ্ছে।
কর্মচারীদের প্রতিক্রিয়া
এই খবরগুলো কর্মচারীদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। তারা বলছেন, বর্তমান বাজারের পরিস্থিতিতে ৩৫,০০০ টাকা সর্বনিম্ন বেসিক এবং ১:৪ অনুপাত ছাড়া কোনোভাবেই নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের পক্ষে সম্মানজনক জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। তাদের দাবি, বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ছিল, তা বেতন স্কেলের এই পুরনো বৈষম্য দিয়েই শুরু হলে তা ইতিহাসের পাতায় অসন্তোষের জন্ম দেবে।