১ দফা জাতীয়করণের দাবী ২০২৫ । বুধবারের মধ্যে প্রজ্ঞাপন না এলে আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের?
ঢাকা: ১৫ অক্টোবর, ২০২৫, বুধবার বেতন বৈষম্য নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট তিন দফা দাবি মেনে নিয়ে আজ বুধবারের (১৫ অক্টোবর) মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করা না হলে, কঠোর আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। তাদের চলমান কর্মসূচি থেকে সরে এসে এবার ‘এক দফা-জাতীয়করণ’-এর চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা।
মঙ্গলবার সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ পুলিশি বাধায় আটকে যাওয়ার পর এই কড়া বার্তা দেন ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট’-এর সদস্য সচিব অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন আজিজী।
শাহবাগ ব্লকেড ও আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারি
মঙ্গলবার হাইকোর্ট সংলগ্ন মাজার গেটে পুলিশের বাধার মুখে কর্মসূচি শেষ করে শিক্ষক-কর্মচারীরা। এ সময় অধ্যক্ষ আজিজী ঘোষণা করেন, যদি বুধবার (আজ) বেলা ১১টার মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি মেনে নেওয়ার সুনির্দিষ্ট প্রজ্ঞাপন বা ঘোষণা না আসে, তবে তারা নতুন ও কঠোর কর্মসূচি হাতে নেবেন।
তিনি বলেন, “আজকে যদি আমাদের দাবি না মানা হয়, আগামীকাল (বুধবার) আমরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করবো। এরপরও যদি দাবি না মানে, আমরা হয়তো যমুনার দিকেও যাব। সর্বশেষ, আমাদের দাবি আদায় না হলে শিক্ষক সমাজ আমরণ অনশনে যেতে বাধ্য হবে।”
অধ্যক্ষ আজিজী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আলোচনার সব পথ শেষ হয়েছে। সরকার বারবার আমাদের অন্ধকারে রাখছে। এখন আর কথার নয়, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা চাই। আন্দোলন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ নেই।”
শিক্ষকদের ৩ দফা দাবি
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মূলত তিনটি দাবি বাস্তবায়নের প্রজ্ঞাপন চান, যা গত আগস্ট মাসে শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে নীতিগতভাবে গৃহীত হয়েছিল বলে তারা দাবি করেন। দাবিগুলো হলো:
১. বাড়িভাড়া ভাতা: মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া প্রদান (ন্যূনতম ৩,০০০ টাকা)। ২. চিকিৎসা ভাতা: শিক্ষক-কর্মচারী উভয়ের জন্য মাসে ১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা করা। ৩. উৎসব ভাতা: কর্মচারীদের জন্য উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করা।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অভিযোগ, গত ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবসে বাড়িভাড়া মাত্র ৫০০ টাকা বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যা তাদের চরমভাবে হতাশ করে এবং চলমান আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
চলমান কর্মসূচি
তিন দফা দাবির প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত সারাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি ঘোষণা করেছেন শিক্ষকরা। শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও কোনো শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন না।
শিক্ষক নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদি তাদের এই ৩ দফা দাবি মানা না হয়, তবে তারা তাদের মূল ও পুরোনো দাবি “এক দফা-শিক্ষা জাতীয়করণ”-এর চূড়ান্ত আন্দোলনে ফিরে যাবেন।
সরকার কেন এই দাবী মেনে নিচ্ছে না?
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবিগুলো সরকার এখনই মেনে না নেওয়ার মূল কারণ হলো এর বিশাল আর্থিক সংশ্লিষ্টতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক নীতিগত চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক-কর্মচারীরা যে ‘এক দফা জাতীয়করণের’ দিকে যেতে চাইছেন, সেই জাতীয়করণ বাস্তবায়নে সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো নিম্নরূপ:
১. বিশাল আর্থিক চ্যালেঞ্জ (Financial Burden)
শিক্ষকদের মূল দাবি পূরণ না করার প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত অর্থ সংস্থানের প্রয়োজনীয়তা।
- জাতীয়করণের বিপুল ব্যয়: বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি এমপিওভুক্ত। যদি সরকার এই বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে (প্রায় ৩৯ হাজার প্রতিষ্ঠান) সম্পূর্ণরূপে জাতীয়করণ করে, তবে এর জন্য বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
- বিশেষজ্ঞদের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শিক্ষা জাতীয়করণ করলে প্রতি বছর সরকারের অতিরিক্ত ৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি লাগতে পারে। সরকারের পক্ষে একসঙ্গে এত বড় আর্থিক বোঝা বহন করা একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ।
- ভাতা বৃদ্ধির আর্থিক চাপ: শিক্ষকদের বর্তমান যে তিনটি দাবি (২০% বাড়িভাড়া, ১,৫০০ চিকিৎসা ভাতা ও কর্মচারীদের ৭৫% উৎসব ভাতা) রয়েছে, সেগুলোর প্রজ্ঞাপন জারি হলেও সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হবে। সরকার এখন পর্যন্ত যে ভাতা বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে, তা শিক্ষকদের দাবির তুলনায় অপর্যাপ্ত হওয়ায় শিক্ষকরা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
২. নীতিগত ও কাঠামোগত জটিলতা (Policy and Structural Issues)
জাতীয়করণের মতো বড় সিদ্ধান্ত শুধু আর্থিক নয়, নীতিগত ও কাঠামোগত সমস্যাও তৈরি করে:
- শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ: জাতীয়করণ করা হলে সব শিক্ষকের চাকরির শর্ত, পদোন্নতি ও বদলি সরকারি নিয়মের আওতায় চলে আসবে। এতে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
- শিক্ষার দর্শন ও অগ্রাধিকার: সরকারের অর্থনৈতিক নীতি, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তির কারণে সরকার সেবা খাতকে উদারীকরণ বা বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার দিকে বেশি ঝুঁকেছে। ফলে শিক্ষায় বিপুল পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
- অনিয়ম ও দুর্নীতি: শিক্ষা খাতে ইতিমধ্যেই যে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, জাতীয়করণ হলে তা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে।
৩. রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব (Lack of Political Will)
শিক্ষক নেতাদের মতে, অর্থের অভাবের চেয়েও বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। তারা যুক্তি দেন যে, দেশের অন্যান্য খাতে অপচয় এবং অতিরিক্ত অর্থ অব্যবহৃত থাকার নজির থাকলেও শিক্ষার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না হওয়া জাতীয় অগ্রাধিকারের অভাবকেই তুলে ধরে।

