বৈষম্যহীন পে-স্কেলের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ২০২৫ । ১:৪ বেতন কাঠামো কি কাজের গতি ও সুশাসন আনবে?
পে-কমিশন যদি সত্যিই দ্রুততার সাথে ১:৪ অনুপাত, ১২টি গ্রেড এবং বাজারমূল্য অনুযায়ী সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা মূল বেতনের মতো বৈপ্লবিক সুপারিশমালা প্রণয়ন করে, তবে এর প্রভাব কেবল কর্মচারীদের ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কার্যকারিতায় এক বড় পরিবর্তন আনবে। নতুন, ন্যায্য এবং স্বচ্ছল বেতন কাঠামোর কারণে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো আসবে, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলো হবে নিম্নরূপ:
১. কাজের প্রতি মনোনিবেশ ও দুর্নীতি হ্রাস
আর্থিক অসচ্ছলতা অনেক সময় কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি করে, যা তাদের কাজের মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং দুর্নীতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। ন্যায্য বেতন কাঠামো নিশ্চিত হলে:
- সেবা প্রদানে মনোযোগ বৃদ্ধি: কর্মচারীরা তাদের জীবনধারণের চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে কাজ বা সেবা প্রদানের প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হবেন।
- দুর্নীতিতে লাগাম: জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ নিশ্চিত হলে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম গ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে অসাধু পথে উপার্জনের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে কমবে, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
২. আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি
নতুন স্কেলটি মূল্যস্ফীতির চাপ বিবেচনা করে প্রণীত হলে কর্মচারীরা আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে পাবেন এবং হাফ ছেড়ে বাঁচবেন। এর ফলে:
- মানসিক স্বস্তি: জীবনধারণের ব্যয় নির্বাহের চাপ কমলে তারা মানসিক শান্তি পাবেন, যা তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে স্থিতিশীল করবে।
- সামাজিক মর্যাদা: একটি সম্মানজনক বেতন কাঠামো সরকারি চাকরিজীবীদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াবে, এবং মেধাবীরা এই পেশায় আসতে আরও বেশি উৎসাহিত হবেন।
৩. জনসেবায় গতি ও ভোগান্তি মুক্তি
কর্মচারীদের মানসিক সন্তুষ্টির সরাসরি প্রভাব পড়ে জনসেবার ওপর। ন্যায্য বেতন স্কেল কার্যকর হলে:
- সেবার মানোন্নয়ন: কর্মচারীদের সন্তুষ্টি বাড়লে তারা জনগণের প্রতি আরও ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল হবেন, ফলে জনগণকে সেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হবে না।
- স্বচ্ছতা ও গতি: দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে কাজ করার প্রবণতা বাড়বে, যা সরকারি অফিসগুলোর সামগ্রিক সেবার গতিকে ত্বরান্বিত করবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, একটি সময়োপযোগী পে-স্কেল কেবল বেতন বৃদ্ধির বিষয় নয়; এটি সুশাসন, দুর্নীতি দমন এবং জনগণের ভোগান্তি দূর করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। পে-কমিশনের উচিত হবে এই বৃহত্তর লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সুপারিশমালা প্রণয়ন করা।
পে-কমিশনের সম্ভাব্য যুগোপযোগী সুপারিশমালা যদি ১:৪ অনুপাত ও সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা বেতনের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে, তবে তা যে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দ্রুত ইতিবাচক সাড়া ফেলবে, দুর্নীতি কমাবে এবং সেবা ত্বরান্বিত করবে—এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এই ইতিবাচক পরিবর্তনটি সরকারি অফিসের প্রায় সব স্তরেই অনুভূত হবে। তবে, আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী, কোন বিভাগে সবচেয়ে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করা যায়, সেই বিষয়ে বিশ্লেষণ করে বলা যায়:
যে বিভাগগুলোতে দ্রুততম ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করা যায়
নতুন পে-স্কেল কার্যকর হলে সবচেয়ে দ্রুত ও দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে জনগণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত (Face-to-Face Public Service) এবং নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের সংখ্যা বেশি—এমন বিভাগগুলোতে। এই কারণে নিম্নলিখিত দুটি ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন দেখা যেতে পারে:
১. ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস
এই দুটি অফিসেই জনগণের সাথে আর্থিক লেনদেন এবং দ্রুত সেবা পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। সাধারণত, নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের অসচ্ছলতা বা সুযোগের অভাবে এই বিভাগগুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ এবং সেবা পেতে ভোগান্তি বেশি থাকে।
- পরিবর্তনের কারণ: সর্বনিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লে (যেমন ৮,২৫০ টাকা থেকে ৩৫,০০০ টাকা), তাদের আর্থিক অসচ্ছলতা দূর হবে এবং উপরি আয়ের (ঘুষ) প্রতি আকর্ষণ কমবে।
- ফলাফল: দ্রুত সেবা প্রদান এবং ক্ষুদ্র দুর্নীতি (যেমন ফাইল এগিয়ে দেওয়ার জন্য ‘বকশিশ’ বা ছোট অঙ্কের ঘুষ) কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এখানকার পরিবর্তন হবে সবচেয়ে দ্রুত ও দৃশ্যমান। জনগণ সরাসরি এই স্বস্তি অনুভব করতে পারবে।
২. স্বাস্থ্য বিভাগ (বিশেষত মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা)
মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য সহকারী, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেন। জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের তুলনায় কম বেতন তাদের কাজের গতি ও মনোযোগে প্রভাব ফেলে।
- পরিবর্তনের কারণ: ন্যায্য বেতন পেলে এই কর্মচারীরা উচ্চ মনোবল নিয়ে কাজ করবেন। এছাড়া, বিভিন্ন ভাতা ও গ্রেড বৈষম্য দূর হলে তাদের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা কেটে যাবে।
- ফলাফল: টিকা কার্যক্রম, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য কার্যক্রমে সেবার মান বাড়বে এবং কর্মচারীদের উপস্থিতি ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পাবে। এই পরিবর্তনও গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছাবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, নতুন পে-স্কেল যেহেতু মূলত আর্থিক স্বস্তি ও মর্যাদা এনে দেবে, তাই যে বিভাগগুলোতে এতদিন আর্থিক টানাপোড়েন জনিত কারণে দুর্নীতি ও সেবার ধীরগতি ছিল, সেখানেই সবচেয়ে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য বিভাগ সেই পরিবর্তনের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।