সর্বশেষ প্রকাশিত

সচিবালয় ও বাইরে: সরকারি কর্মচারীদের পদ-বেতন বৈষম্য নিরসনে দীর্ঘসূত্রিতা

সচিবালয় ও তার বাইরের সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে পদ ও বেতন বৈষম্য নিয়ে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ বিরাজ করছে, যা এখন চরম ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। একই শিক্ষাগত যোগ্যতা, বেতন স্কেল এবং কাজের দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি ও বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

বৈষম্যের প্রেক্ষাপট

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সচিবালয় ও তার বাইরের বিভিন্ন দপ্তরে উচ্চমান করণিক নামে একটি পদের সৃষ্টি হয়। ১৯৮৪ সালে এমএল কমিটির সুপারিশে এই পদটি উচ্চমান সহকারী পদে পরিবর্তিত হয়। এরপর ১৯৯৫ সালের একটি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সচিবালয়ে কর্মরত প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী, বাজেট পরীক্ষক এবং সাঁটলিপিকারদের পদবি পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা করা হয়। ১৯৯৭ সালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা লাভ করে এবং তাদের বেতন স্কেল উন্নত করা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৯৯ সালে তাদের বেতন গ্রেড ১০-এ উন্নীত করা হয়।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সচিবালয়ের বাইরে বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরে কর্মরত একই যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মচারীদের পদ ও বেতন স্কেল অপরিবর্তিত থাকে। যদিও পরবর্তী সময়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উচ্চমান সহকারীদের পদবি পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হয় এবং তাদের বেতন গ্রেড ১০-এ উন্নীত করা হয়, অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন।


আন্দোলন ও সরকারি পদক্ষেপ

এই বৈষম্য দূর করার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদ ২০০৯ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছে। তারা সংবাদ সম্মেলন, কালোব্যাজ ধারণ, এবং মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কিন্তু কোনো চূড়ান্ত সমাধান আসেনি।

  • ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
  • জনাব ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পে-কমিশন সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতো মাঠ প্রশাসনের উচ্চমান সহকারীদেরও সমমর্যাদা ও সমবেতন স্কেল প্রদানের সুপারিশ করে।
  • ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান।
  • জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একাধিকবার এই পদ ও বেতন বৈষম্য দূর করার জন্য সুপারিশ করে। ২০১৯ সালের ৯ মে এবং ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি সচিবালয়ের বাইরের দপ্তরের উচ্চমান সহকারীদের পদবি পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করার এবং তাদের বেতন গ্রেড ১০-এ উন্নীত করার জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুপারিশ করে।

স্থবিরতা ও কর্মচারীদের ক্ষোভ

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বারবার সুপারিশ সত্ত্বেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দপ্তরের কাছে নতুন করে প্রস্তাব পাঠানোর কথা বলে প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে। সর্বশেষ, ২০২০ সালে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সুপারিশ করেন এবং একটি উপকমিটি গঠিত হয়। এই উপকমিটি ২০২১ সালে ঐক্য পরিষদের দাবিকে যৌক্তিক ও সময়োপযোগী বলে অভিহিত করে বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। কিন্তু এরপরও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসায় কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

এই বৈষম্যকে কর্মচারীরা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী বলে মনে করেন। তারা বলছেন, যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই একই বৈষম্য স্বাধীন দেশে সরকারি প্রশাসনে এখনও বিদ্যমান। বৈষম্যমুক্ত প্রশাসন গঠনের লক্ষ্যে এই ন্যায্য অধিকার দ্রুত বাস্তবায়নে কর্মচারীরা এখন প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *