বিশাল অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাঝে বৈষম্যের শিকার ২০২৫ । আটগুণ বাজেট বৃদ্ধিতেও বাড়ি ভাড়া বেড়েছে মাত্র ৫০০ টাকা!
শিক্ষকদের ২০% বাড়ি ভাড়ার দাবি কি অযৌক্তিক?—বিশাল অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাঝে বৈষম্যের শিকার এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা
[ঢাকা, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫]
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বাড়ি ভাড়া ভাতার চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে শুরু করে বর্তমান অর্থবছর পর্যন্ত দেশের বার্ষিক বাজেট যেখানে প্রায় আট গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে তাদের বাড়ি ভাড়া ভাতা বেড়েছে মাত্র ৫০০ টাকা! এই নজিরবিহীন বৈষম্যের প্রতিবাদে তারা এখন মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাতার দাবিতে অনড় অবস্থানে রয়েছেন। সূত্র মতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫% থেকে ২০% হারে বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব দিলেও, শিক্ষকরা ২০ শতাংশের এক পয়সা কম মানতে নারাজ।
বাজেট বেড়েছে আটগুণ, বাড়ি ভাড়া সামান্য!
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেট ছিল ৯৯,৯৬২ কোটি টাকা। সেই সময় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বাড়ি ভাড়া পেতেন ৫০০ টাকা। ২০১৫ সালে এসে এটি ১,০০০ টাকা করা হয়। চলতি বছরে দেশের বাজেট প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থাৎ এই সময়ে বাজেট বেড়েছে প্রায় আট গুণ। কিন্তু এই বিশাল অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের বিপরীতে তাদের বাড়ি ভাড়া বেড়েছে কেবল ৫০০ টাকা। বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে যা সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে এই আর্থিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন। তাদের দাবি, সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা জাতীয় বেতনস্কেল, ২০১৫ অনুযায়ী মূল বেতনের আনুপাতিক হারে বাড়ি ভাড়া পান। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে এই সুবিধা প্রযোজ্য নয়, যা সংবিধানের ২৭, ২৯ ও ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী বলে মনে করছেন অনেকে।
শিক্ষকদের কঠোর অবস্থান: ২০ শতাংশের নিচে নামা হবে না
সম্প্রতি, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ভাতা ৫০০ টাকা বাড়িয়ে ১,৫০০ টাকা করার প্রস্তাব অনুমোদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এই ঘোষণায় শিক্ষকরা আরও বেশি হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস-এর সূত্র মতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও, শিক্ষক নেতারা বলছেন, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করে তাদের মূল বেতনের ২০ শতাংশের নিচে এক পয়সা কম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক নেতা বলেন, “যখন দেশের বাজেট আট গুণ বৃদ্ধি পায়, তখন আমাদের মতো শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পায় কেবল ৫০০ টাকা—এটা এক ধরনের উপহাস! আমরা দেশের শিক্ষাখাতকে এগিয়ে নিতে জীবন দিয়ে কাজ করি, কিন্তু আমাদের ন্যূনতম চাহিদাগুলোকেও উপেক্ষা করা হয়। আমরা মনে করি, এই বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ হওয়া উচিত এবং আমাদের ন্যায্য দাবি, অর্থাৎ ২০% বাড়ি ভাড়া অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।”
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এই দাবি এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং ন্যায্য অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষার দাবি হিসেবেও জোরালো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশবাসী ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে তাদের প্রশ্ন—দেশের এই বিশাল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির বাজারে, মাত্র ৫০০ টাকা বাড়ার প্রেক্ষাপটে, তাদের ২০% বাড়ি ভাড়ার দাবিটি কি সত্যিই অযৌক্তিক? এই প্রশ্নের উত্তর এখন সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।
২০% বাড়ি ভাড়া দিলে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে কত টাকা?
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা দেওয়া হলে সরকারের বার্ষিক অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ২,৩০০ কোটি টাকা থেকে ২,৬০০ কোটি টাকার মধ্যে।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এই ব্যয়ের পরিমাণ কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। কয়েকটি প্রধান তথ্যসূত্র থেকে প্রাপ্ত হিসাবগুলো নিম্নরূপ:
- দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদন (মাউশি-এর তথ্যের ভিত্তিতে):
- ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া দিতে বছরে লাগবে ২,৩৫১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
- এতে প্রতি মাসে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ১৯৬ কোটি টাকা।
- জাগোনিউজ২৪ এবং রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদন (এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের হিসাব):
- ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া দিতে বছরে অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে ২,৫৯২ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
- এতে প্রতি মাসে অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে ২১৬ কোটি ২ লাখ টাকা।
বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতি মাসে ১,০০০ টাকা হারে (সম্প্রতি ১৫০০ টাকা করার প্রস্তাব অনুমোদনের কথা বলা হলেও, পুরনো হিসাব অনুযায়ী) বাড়ি ভাড়া পান। এই হিসাবটি শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা এবং তাদের বর্তমান মূল বেতনের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদ এবং সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষকদের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়াতে এই অতিরিক্ত ব্যয় যৌক্তিক। তারা উল্লেখ করেন যে সরকার প্রতি বছর শিক্ষা খাতে বিশাল অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ করে, সেখান থেকে এই খরচ মেটানো সম্ভব।

